মার্কেটিংয়ে ডেটা সায়েন্স ব্যবহার করার ৫টি উপায়

মার্কেটিংয়ে ডেটা সায়েন্সের ভূমিকা

আপনি কি কখনো অনলাইন কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে কোনো কিছু কেনা কাটা করেছেন? করতে গিয়ে আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, আপনাকে সবসময় একই ধরনের কিছু পণ্য ও সামগ্রী কিনার বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এখানেই রয়েছে মার্কেটিং জগতে ডেটা সায়েন্সের প্রয়োগ। 

বর্তমান দুনিয়ার বেশিরভাগ ডেটা গত দুই বছরে তৈরি করা হয়েছে। তার সাথে সাথে আগের চেয়ে কোম্পানিগুলো আরো দ্রুত এই ডেটাসমূহ সংগ্রহ এবং অ্যানালাইস করতে পারছে। একজন ব্যক্তি যতবার একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া পৃষ্ঠা বা POS সিস্টেমের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করে, ততবারই নতুন নতুন ডেটা পয়েন্ট তৈরি হতে থাকে। 

এই ডেটা পয়েন্টগুলো পরবর্তীতে ডেটা ব্যবহারকারীদের ইন্সাইট তৈরি করতে সাহায্য করে। ডেটা ইন্সাইট তৈরির মাধ্যমেই কোম্পানিরা বুঝতে পারে, কোন ধরনের বিজ্ঞাপন কাকে প্রদান করলে সবচেয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব। 

আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মার্কেটিং এর উদ্দেশ্যে তৈরি ডেটা সায়েন্স অ্যাপ্লিকেশনের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করি এবং অসচেতনভাবে হলেও সেগুলির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিই।

এই নিবন্ধটিতে আমরা মার্কেটিংয়ে ডেটা সায়েন্সের ৫ টি ব্যবহার এবং তার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করবো। 

মার্কেটিংয়ের ৫ টি ক্ষেত্রে ডেটা সায়েন্স

১। রিকমেন্ডেশন সিস্টেম

Netflix, Spotify এবং Amazon-এর মতো কোম্পানিগুলি তাদের ইউজারদের যার যার পছন্দের কন্টেন্ট দেখানোর জন্য রিকমেন্ডেশন সিস্টেম ব্যবহার করে থাকে। যা মূলত তাদের ইউজারদের এসব সাইটের সাথে ইন্টারেকশনের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি Netflix-এ একটি মুভি দেখেন এবং এটিকে একটি ইতিবাচক রেটিং দেন, পরের বার আপনি যখন অ্যাপটি খুলবেন, তখন আপনাকে একই ধরনের বিষয়বস্তু এবং কাস্ট সদস্যদের  মুভি রিকমেন্ড করা হবে।

একজন ব্যবহারকারী এই রিকমেন্ডেশন সিস্টেমের সাথে যত বেশি ইন্টারেক্ট করবে, তা ততই শক্তিশালী এবং নির্ভুল হতে থাকবে। 

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি Spotify-এ নতুন হন, আপনার প্রাথমিক গানের পরামর্শগুলি খুবই জেনেরিক হবে। অ্যালগরিদমে আপনার পছন্দগুলি জানার জন্য পর্যাপ্ত ডেটা না থাকায় অ্যাপটি বিভিন্ন ধরনের গানের সুপারিশ করবে, যেগুলো বেশিরভাগ মানুষই শুনেছে। 

আপনি অ্যাপটিতে যত বেশি সময় কাটাবেন এবং তার সাথে সাথে রিকমেন্ডেশন সিস্টেমও তত ভালো বুঝা শুরু করবে যে, আপনি কোন ধরনের গানগুলো বেশি পছন্দ করেন। আবার কোন ধরনের গানগুলো বেশি পছন্দ করেন না, সেগুলোও রিকমেন্ডেশন সিস্টেম যাচাই করতে পারা শুরু করে। এরপর এই তথ্যগুলোর উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে আপনি কোন ধরনের গান পছন্দ করতে পারেন, তা অনুমান করে আপনাকে দেখানো হয়। 

রিকমেন্ডেশন সিস্টেমের বিভিন্ন ধরন

রিকমেন্ডেশন সিস্টেমগুলোকে প্রধানত দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। একটি হলো বিষয়বস্তু ভিত্তিক রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (Content Based Recommendation System) এবং আরেকটি হলো সহযোগী ফিল্টারিং ভিত্তিক রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (Collaborative Filtering Based Recommendation Systems)। 

১। বিষয়বস্তু ভিত্তিক রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (Content-Based Recommendation Systems)

বিষয়বস্তু ভিত্তিক রিকমেন্ডেশন সিস্টেম শুধুমাত্র পণ্যের বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে পরামর্শ নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ- আপনি যদি “পার্সি জ্যাকসন” সিরিজের উপন্যাসগুলি পড়ে উপভোগ করেন, তাহলে আপনাকে “অলিম্পাসের হিরোস” রিকমেন্ড করা হতে পারে, যেটি একই লেখকের দ্বারা লেখা এবং একই ধরনের জনরার অন্তর্ভুক্ত। 

কিন্তু, এই ধরনের রিকমেন্ডেশন সিস্টেম-এর অসুবিধা হলো আপনি সাধারণত যেই বইগুলো পছন্দ করেন, তার বাইরে কোনো ধরনের বই বা কন্টেন্ট আপনাকে রিকমেন্ড করা হবে না। আপনি যদি পার্সি জ্যাকসন পছন্দ করেন, তাহলে আপনাকে শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চার এবং ফ্যান্টাসি বই সুপারিশ করা হবে, যেখানে আপনি অন্য নন-ফিকশন বা সাসপেন্স উপন্যাস উপভোগ করতেই পারেন।

আপনি Collaborative Filtering Based Recommendation Systems ব্যবহারের মাধ্যমে এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারেন। 

২। সহযোগী ফিল্টারিং ভিত্তিক রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (Collaborative Filtering Based Recommendation Systems)

এই সিস্টেমটি অতীতে একজন ব্যবহারকারীর আচরণের উপর ভিত্তি করে পরামর্শ প্রদান করতে ব্যবহৃত হয়। যেগুলোকে ইউজার-ভিত্তিক এবং আইটেম-ভিত্তিক সহযোগী ফিল্টারিং-এ পরবর্তীতে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে।

আমরা এই সিস্টেমটির নাম থেকেই বুঝতে পারছি যে, এখানে একই ধরনের আচরণগত ব্যবহারকারীগুলো একত্রীত করা হয়ে থাকে। 

এরপর সিস্টেমের অ্যালগরিদমটি তাদের আচরণের উপর ভিত্তি করে রিকমেন্ডেশন প্রদান করে থাকে। যা নিচে দেখানো হয়েছে - 


অন্যদিকে, আইটেম-ভিত্তিক সহযোগী ফিল্টারিং সিস্টেমে ব্যবহারকারীদের তাদের পছন্দের উপর ভিত্তি করে অনুরূপ আইটেমগুলিকে একত্রিত করা হয়, যেমনটি এই ছবিতে দেখানো হয়েছে:

২। সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস

সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস, যা অপিনিয়ন মাইনিং নামেও পরিচিত, এটি হল পাঠ্যের একটি অংশের পিছনে অন্তর্নিহিত আবেগ নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এটি মার্কেটিংয়ে ডেটা বিজ্ঞানের আরেকটি জনপ্রিয় প্রয়োগ।

দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ব্যাংক লক্ষ্য করে যে, তাদের সাধারণ গ্রাহক সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তাদের বেশিরভাগ গ্রাহকই ধীরে ধীরে তাদের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু, সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস-এর সাহায্যে তারা পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। 

তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তাদের সাধারণ ইউজাররা তাদের সম্পর্কে কি ধরনের মতামত পোষণ করছে, তার প্রায় ২ মিলিয়ন ডেটা পয়েন্ট সংগ্রহ করে।  এরপর, সেই ডেটার উপর ভিত্তি করে একটি সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস মডেল তৈরি করে। 

এই মডেলের উপর ভিত্তি করে, প্রতিষ্ঠানটি বুঝতে পেরেছে যে বেশিরভাগ নেতিবাচক মন্তব্য সেইসব ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে এসেছে, যারা লাঞ্চ আওয়ারে ব্যাংক এর অপর্যাপ্ত সার্ভিসের সম্মুখীন হয়েছিল। যেখানে তাদের দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ব্যাংকটি পরবর্তীতে লাঞ্চ আওয়ারে আরো কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে যথাযথ সার্ভিসের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। 

এভাবেই, সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে বর্তমানে কোম্পানিগুলো নানান ধরনের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে। 

৩। গ্রাহক মন্থন অনুমান (Customer Churn Prediction) 

গ্রাহক মন্থন হল এমন একটি ঘটনা যা ঘটে যখন একজন ব্যবহারকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করা বন্ধ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একজন Netflix ব্যবহারকারী হন এবং প্ল্যাটফর্মটি থেকে আপনার সাবস্ক্রিপশন শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন, আপনি একজন গ্রাহক যিনি মন্থন করেছেন।

একজন মন্থন করা গ্রাহককে প্রতিস্থাপন করা কোম্পানিগুলির জন্য একটি বিদ্যমান গ্রাহককে ধরে রাখার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এই কারণে, অনেক সংস্থা এরকম ব্যবহারকারীদের ধরে রাখতে ডেটা সাইন্টিস্টদের নিয়োগ করে, যারা বিভিন্ন অ্যালগরিদমের সাহায্য অনুমান করতে পারে যে, কারা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অসন্তুষ্ট এবং ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

উদাহরণস্বরূপ - আপনি যদি কোনো ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানকারী কোম্পানিতে সাবস্ক্রাইব করার পর লক্ষ্য করেন যে সম্প্রতি তারা ধীরগতি সম্পন্ন সার্ভিস প্রদান করছে; যে বিষয়ে আপনি কোম্পানির হেল্প সেন্টারকেও কয়েকবার জানিয়েছেন। কিন্তু, তারপরও তারা তাদের এই সমস্যা সমাধান করছে না। এমতাবস্থায়, আপনি শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিযোগী কোম্পানিতে সুইচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কারণ, আপনার এই ISP-এর সাথে অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ ছিল।

এ ক্ষেত্রে পূর্বের ISP কোম্পানিটি ডেটা সায়েন্সের মাধ্যমে, তাদের গ্রাহকের আচরণগত ডেটা এবং অভিযোগের ডেটা সংগ্রহ করতে পারে। যা থেকে তারা অনুমান করতে পারে যে, তাদের ব্যবহারকারীদের মধ্যে কারা মন্থনের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই ডেটার সাহায্যে তারা দ্রুত সে সকল ব্যবহারকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে, যা তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে। 

উপরের উদাহরণটি দেখে আশা করছি আপনারা বুঝতে পারছেন যে, এই ধরনের মডেল একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। 

৪। গ্রাহক বিভাজন (Customer Segmentation)

গ্রাহক বিভাজন হলো গ্রাহকদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করার প্রক্রিয়া। এরপর প্রতিটি গ্রুপের আচরণের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন এবং পণ্য অফার করা হয়ে থাকে। 

উদাহরণস্বরূপ - একটি ই-কমার্স কোম্পানি এই ধরনের কাস্টমার সেগমেন্টেশন মডেল তৈরি করে থাকে, যাতে তারা তাদের ব্যবহারকারীদের পার্সনালাইজড বা ব্যক্তিগত অফার বা সার্ভিস প্রদান করতে পারে। 

একজন, গ্রাহক যদি প্রায়ই একটি ই-কমার্স সাইট ভিজিট করে থাকে, কিন্তু কেবল তখনই কোনো পণ্য ক্রয় করে যখন কোনো ডিস্কাউন্ট চলতে থাকে। এ ধরনের গ্রাহকদেরকে প্রোমোশন হান্টার বলা হয়ে থাকে। তাই এই সেগমেন্টের সমস্ত গ্রাহকদের অবিলম্বে একটি ইমেল বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় যখনই তাদের একটি চলমান ডিসকাউন্ট চলতে থাকে কারণ তারা এই সময়ে আরও কেনাকাটা করতে পারবে। 

অন্যদিকে, কিছু ব্যবহারকারী কিছু নির্দিষ্ট আইটেমের জন্যই কেনাকাটা করে; তারা সাধারণত মূল্য নির্বিশেষে ক্রয় করতে ইচ্ছুক কারণ তারা ক্রয়ক্ষমতার চেয়ে গুণমানকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এই গ্রাহকদের আলাদাভাবে টার্গেট করা হয়। এরপর কোম্পানির মার্কেটিং দল এই গ্রুপের গ্রাহকদের উচ্চ-সম্পন্ন আইটেমগুলির বিজ্ঞাপন দেয় যেগুলোর প্রতি তারা ইতোমধ্যেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এভাবেই, গ্রাহকদের বিভিন্ন রকমের আচরণগত বৈশিষ্ট্য-এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের টার্গেট করে থাকে এবং বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম সার্ভিস প্রদান করে থাকে। 

৫। মার্কেট বাস্কেট অ্যানালাইসিস (Market Basket Analysis)

মার্কেট বাস্কেট অ্যানালাইসিস, যা অ্যাসোসিয়েশন মাইনিং নামেও পরিচিত, এমন একটি কৌশল যা প্রায়শই একসাথে কেনা আইটেমগুলি অ্যানালাইস করতে ব্যবহৃত হয়। এর জন্য পণ্যগুলোকে ঐতিহাসিক ডেটা সংগ্রহ করে, একই সাথে প্রায়ই কেনা হয়ে থাকে, এমন পণ্যগুলোকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। 

এই ধরনের অ্যানালাইসিস খুচরা বিক্রেতাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারে। যেমন - তাদের দোকানের পণ্যের গঠন পরিবর্তন করা এবং গ্রাহকদের একই সাথে অনেক ধরনের পণ্য কিনতে উৎসাহ করা। 

উদাহরণস্বরূপ- একজন ব্যক্তি যিনি বেবি ফরমুলা কিনে থাকেন, তার ডায়াপার কেনার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই দোকানগুলি সাধারণত ব্যবহারকারীদের কাছে সহজে অ্যাক্সেসযোগ্য করার জন্য এই আইটেমগুলি একে অপরের কাছাকাছি রাখে।

কিন্তু, এ ধরনের প্যাটার্ন সবসময় সব জাগায় একই হয় না। অঞ্চল, সাংস্কৃতিক প্রভাব, এবং জনসংখ্যার কারণে গ্রাহকদের আচরণ আলাদা হয়ে থাকে। তাই এ রকম পারস্পরিক সম্পর্কগুলো অনেক সময়ই একজন সাধারণ মানুষ নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে পারে না, যে কারণে সংস্থাগুলি মার্কেট বাস্কেট অ্যানালাইসিসের জন্য ডেটা বিজ্ঞানের কৌশলগুলির উপর নির্ভর করে।